চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে সামনে রেখে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করে বৈশ্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বিশ্বায়নের চ্যালেন্জ মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পলিসি মেকিং করতে হবে। তাই সাম্প্রতিক কালে নির্দিষ্ট বয়স সীমা তুলে দেওয়ার ছাত্র – ছাত্রীদের দাবি যৌক্তিক ও সময়োপযোগী ।
পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশগুলোতে চাকুরির নির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমা আছে। ফলে বাংলাদেশের অনেক চাকরি প্রত্যাশী দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলন করে আসছে । বাংলাদেশে যদি চাকরি প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সসীমা তুলে দেয়া বা বয়স সীমা বৃদ্ধি করা হয় সেক্ষেত্রে ছাত্র- ছাত্রী ও দেশের জন্য কি কি সুযোগ তৈরি হতে পারে ?
প্রথমত: নির্দিষ্ট বয়সসীমা না থাকলে বাংলাদেশের প্রচুর পরিমাণ শিক্ষিত জনশক্তি বিদেশে যাওয়ার হার বেড়ে যাবে। কারন দেশের বেশির ভাগ শিক্ষিত শ্রেণি বিদেশে যাওয়ার প্রতি অনীহা রয়েছে এবং নির্দিষ্ট বয়স সীমা থাকার কারনে তারা সরকারি চাকুরির জন্য অপেক্ষায় থাকে। বর্তমানে বিদেশে বাংলাদেশী কর্মরত রয়েছে ১ কোটি ৩০ লক্ষ যাদের মাধ্যমে
দেশের বাৎসরিক রেমিট্যান্স আয় মোট ২১ বিলিয়ন ডলার প্রায়। অথচ সেখানে পাকিস্তান ৯০ লাক্ষ প্রবাসী জনশক্তি থেকে তাদের রেমিট্যান্স আয় ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার মানে হলো তাদের শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তির কারণেই তারা আমাদের চেয়ে কম সংখ্যক জনশক্তি পাঠিয়ে অধিক পরিমান রেমিট্যান্স আয় করছে।
দ্বিতীয়ত: বয়সসীমা নির্দিষ্ট না থাকলে বাংলাদেশের কর্পোরেট সেক্টরে অধিক মেধা সম্পন্ন ডাইনামিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের আকৃষ্ট করা যেত।
তৃতীয়ত: বাংলাদেশের সরকারের বিভিন্ন পলিসি মেকিং এ অধিক দক্ষ, অভিজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন আমলা পাওয়া যেত।
চতুর্থত: সরকারি চাকরিতে অসম প্রতিযোগিতা বন্ধ হতো।
পঞ্চমত : বাংলাদেশের চাকরিপ্রার্থির পিতামাতাদের ওপর আর্থিক, সামাজিক ও মানসিক দায়বদ্ধতা কমে যেত। কারন তারা বয়স সীমা কম থাকার অজুহাতে পিতামাতার কাছ থেকে সময় ক্ষেপন করতে পারবে না।
ষষ্ঠত : বাংলাদেশের অর্থনীতি যে তিনটি প্রধান সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল প্রবাসী আয়, গার্মেন্টস বা প্রাইভেট সেক্টর ও কৃষি । এই সেক্টর গুলোর যথাযথ ব্যবহার করতে পারলে আমাদের অর্থনীতি আরো বিকাশিত হত। বর্তমানে জনশক্তির মুল সমস্যা হলো অধিক শিক্ষিত জনগনকে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না, প্রাইভেট সেক্টর গুলোতে যে সংখ্যক মেধাবীদের ঘাটতি তা পূরণ করা যাচ্ছে না এবং কৃষি সেক্টরে আধুনিক শিক্ষিতদের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। বয়স সীমা থাকার কারনে চাকুরী প্রার্থীদের হাতে যে কয়েক বছর অবশিষ্ট থাকে, ফলে প্রার্থীদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয় এবং অভিভাবকদের বুঝাতে সক্ষম হয় যে এই সময়ের মধ্যে সরকারী চাকুরী প্রস্তুতি না নিলে এই সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। অভিভাবকগণ বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে তাদের সন্তানদের আরো সুযোগ দেয়। ফলে অভিভাবকগন অর্থনৈতিকভাবে আরো অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়ে যায়।
সপ্তমত: সরকার প্রতি বছর যে বিপুল পরিমান পেনশনের পিছনে অর্থ ব্যয় করে তা থেকে অনেকাংশ হ্রাস পাবে এবং সেই অর্থ দিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের কাজে লাগানো যাবে।
অষ্টমত: ৩০ বছর নির্দিষ্ট বয়সসীমা থাকার কারণে পরবর্তীতে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গুলোও নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
নবমত: বিদেশ ফেরত ও দেশে বিভিন্ন পেশার দক্ষ ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকজন সরকারি চাকুরিতে প্রবেশ করলে তাদের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সরকারি খরচ কমানো সম্ভব হতো।
দশমত: আমাদের দেশের টেকনিক্যাল ক্যাডার গুলোতে বয়স সীমা থাকার কারনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী যারা বিদেশে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছে তারা দেশের জন্য কাজ করতে চাইলেও পারে না এই বয়স সীমাবদ্ধতার কারণে।
চাকুরির প্রবেশসীমা বেশি থাকলে ছাত্র ছাত্রীরা দেশি বিদেশি বিভিন্ন সংস্থায় চাকুরী ও গবেষণায় অধিক মনোযোগী হতে পারবে পরবর্তীতে কেউ যদি সরকারি চাকুরীতে আসতে চায় সেক্ষেত্রে তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতার দরুন দূর্নীতির প্রবণতা যেমন কম থাকবে তেমনি তাদের অর্জিত মেধা ও অভিজ্ঞতা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। যেহেতু তারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলো তাই কাজের প্রতি তাদের একনিষ্ঠতা ও সেবামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থাকাটা স্বাভাবিক ।
বয়স সীমা বৃদ্ধির ফলে চাকুরির প্রার্থী সংখ্যা হ্রাসের জন্য বিভিন্ন বিধি নিষেধের মাধ্যমে সেটা মোকাবিলা করা যেতে পারে। এছাড়া বয়স সীমা বাড়ানোর বিপক্ষে বা বিরোধী মতের যে যুক্তি রয়েছে সেক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদাহরণ কেন প্রযোজ্য হবে না অথবা বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাবে বলে যে যুক্তি দেওয়া হয় তার উল্টোটাও ঘটতে পারে যদি আমরা দেশের প্রাইভেট সেক্টর গুলোকে অধিক পরিমাণ নিরাপদ পরিবেশ ,আকর্ষণীয়, আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ডে নিয়ে আসা ও দেশের সর্বত্র আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারি তাহলে সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে যে অসম প্রতিযোগিতা আমরা দেখতে পাই সেটা বন্ধ হবে বৈকি। এই বিষয়টি সুরাহা না হওয়ার পিছনে আমাদের দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও প্রান্তিক চিন্তাভাবনাকে অনেকে দায়ি করেন। বয়স সীমা তুলে দেওয়ার আন্দোলনে পক্ষে বিপক্ষে ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি ও মতামত থাকলেও দেশের উন্নতি কল্পে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে সফল করতে হলে অবশ্যই ছাত্র ছাত্রীদের যৌক্তিক দাবিকে আমলে নিয়ে দ্রুত ও আশু সমাধান জরুরি ।
লেখক : মোঃ আল মামুন , প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ধানমন্ডি, ঢাকা